১৩ই অক্টোবর ১৯৭১, সেদিন বুধবার। একাত্তরের এই দিন সকাল বেলায় সংঘটিত হয়েছিল আরেকটি হৃদয় বিদারক নৃশংস গণহত্যা। পাকি জল্লাদ বাহিনী কিশোরগঞ্জে অনুপ্রবেশ করেছিল ১৯শে এপ্রিল এবং ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ কিশোরগঞ্জ শহর থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।

 

তাদের নির্মমতার চূড়ান্ত রূপ, এলাকাবাসী  প্রত্যক্ষ করেছিল ১৩ই অক্টোবর। এদিন হত্যা করা হয় আনুমানিক ৪০০  জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। তাঁদের হত্যা করা হয় রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে। পাকি পশুদের হত্যাযজ্ঞে সেদিন ইন্ধন দিয়েছিল  এলাকার রাজাকার ও দালালেরা।

 

কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলে গেছে কিশোরগঞ্জ-নিকলী সড়ক। এ সড়কের পাশেই বড়ইতলা ময়দান। বড়ইতলার পাশেই মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়ি। ফলে পাকি হার্মাদ বাহিনী ও রাজাকারদের শ্যেন দৃষ্টি পড়ে এলাকাটির উপর।বড়ইতলা গ্রামটি ভৈরব-ময়মনসিংহ রেললাইনের পূর্ব পাশে অবস্থিত। জোহরের নামাজের সময়, পাকিস্তানী সেনাদের হুকুমে, স্থানীয় কিছু রাজাকার ও দালাল দেশের কথিত অখন্ডতা রক্ষা ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখিয়ে আশপাশের চিকনিরচর, দামপাড়া, কালিকাবাড়ি, গোবিন্দপুর, তিলকনাথপুর, ডুবিরচর প্রভৃতি গ্রামের প্রায় ৪৫০ লোককে রেললাইনের পাশে খেলার মাঠে জড়ো করেছিল।

 

মিটিং চলাকালে কয়েকজন পাকি পশু নিকটবর্তী গ্রামে ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণ পর একজন রাজাকার (প্রত্যক্ষদর্শী’রা নিশ্চিত করেছেন চিকনীরচর গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার আবুল হাসিম) এসে সভাস্থলে গুজব ছড়িয়ে দেয় যে, গ্রামবাসীরা দুজন পাকসেনাকে আটক করে গুম করে ফেলেছে। মুহূর্তের মধ্যে পাকসেনারা হিংস্রতায় ফেটে পড়ে এবং  উপস্থিত লোকজনদের  দড়ি, গামছা, লুঙ্গির সাহায্যে একজনের সাথে আরেকজনকে বেঁধে ফেলা হয়, যাতে তারা পালাতে না পারেন।

 

ঘটনা আঁচ করতে পেরে প্রায় অর্ধশত লোক পার্শ্ববর্তী মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেন।  রেললাইনের দুপাশে দাঁড় করিয়ে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এরপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। সেদিনের শহীদ’দের মাঝে ৩৬৫ জন মানুষের নাম জানা যায়। তাঁদের অনেকের লাশের ঠাঁই হয়েছিল গণকবরে।

 

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, গণহত্যায় নিহতদের ভাগ্যে জোটেনি জীবনের শেষ গোসল। তবে দেহ নিঃসৃত উষ্ণ রক্তধারায় হয়েছিল তাঁদের শেষ গোসল। জীবনের শেষ প্রাপ্তি জানাজা ও কবর জোটেনি অনেকের ভাগ্যে। বরং ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল অজানার উদ্দেশ্যে নরসুন্দার পানিতে। প্রত্যক্ষদর্শীরা যাদেরকে এ গণহত্যার সাথে জড়িত বলে জানিয়েছেন, সেই ঘাতকদের আজও কোনো বিচার হয়নি। বরং বীরদর্পে এখনও তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে শহীদনগরে।