সঠিক সংখ্যাটি আজও নির্ণেয় নয়। আমরা (সম্ভবত) কোনদিনই জানতে পারবোনা একাত্তরের ২৫শে মার্চের কালরাত ও তার পরবর্তীতে ঠিক কতজন শহীদ, ‘জগন্নাথ হলে’র বধ্যভূমিতে মিশে আছেন। যদিও আমরা আবেগবশত ‘গণকবর’ আখ্যা দিয়ে এসেছি আজ ৪৯ বছর।
আদৌ কি তা গণকবর ?
নাকি, মানব ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার শিকার অনির্ণেয় শহীদদের মাটি চাপা দেয়া বোবা ইতিহাস,বধ্যভূমি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক রতনলাল চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা :১৯৭১ জগন্নাথ হল’ গ্রন্থের ১৭ পাতায় উল্লেখিত তথ্য থেকে জানা যায়, সেদিন রাতে জগ্ননাথ হল সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ৪ জন, ৩৪ জন ছাত্র, ৪ জন কর্মচারী পাকিস্তানী অমানুষ সেনাদের হাতে শহীদ হন।
একইসাথে তিনি আরও জানিয়েছেন, এই ৪২ জনের বাইরেও হলে উপস্থিত অতিথি সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক, কর্মচারী, রমনা কালীমন্দির ও শিব বাড়ির সাধু ও তাঁদের পরিবারের সদস্য ছাড়াও আরও অগণিতজন ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হন। তাঁদের মৃতদেহ বুলডোজার দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানী হায়েনারা।
২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার ভিডিও ধারণ করেছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল উল্লাহ। সে রাতের বিভীষিকার ক্ষুদ্রতম অংশটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ আবাসের জানালা দিয়ে গোপনে ধারণ করেন। সেরাতে তাঁর ক্যামেরার মাত্র একটি ভিডিও টেপ ছিল, ফলে খুব বেশি ফুটেজ ধারণ সম্ভব হয়নি। আমরা তাঁর কাছে আমৃত্যু কৃতজ্ঞ থাকবো এই ফুটেজের জন্য। যদি তিনি, সেই গণহত্যার করুন দৃশ্য ধারণ না করতেন তবে আজ ২০২০ সালে বাংলাদেশের বহু ‘অমানুষ’ দাবী করতো (প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও করে) সেদিন কোন হত্যা হয়নি!
১৯৭২ সালের ১১ মে বৃহস্পতিবার, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ তদন্ত কমিশনের উদ্যোগে বধ্যভূমিতে খনন করা হয়েছিল। সেই মুহূর্তে জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে উপস্থিত শহীদ স্বজন ও অন্যান্যদের মাঝে নেমে এসেছিল নীরবতা। মানব কংকালের সাথে সাথে তাঁদের শেষ মুহূর্তের পোশাক উঠে আসছিল প্রতি মুহূর্তেই। স্বজনরা বাকরুদ্ধ হয়ে খুঁজছিলেন নুন্যতম চিহ্ন, যা দিয়ে আপনতম মানুষটিকে একবার চেনা যাবে। সেদিনের উদ্ধার করা দেহাবশেষ পুনরায় স্থাপিত হয় বর্তমান ‘গণসমাধি’ প্রাঙ্গনে। তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার স্থাপন করেছিলেন একটি স্মৃতিফলক। ব্যস, এ দুটোই হচ্ছে জগন্নাথ হলে সংঘটিত নৃশংসতম গণহত্যার চিহ্ন।
জগন্নাথ হল প্রাঙ্গনে ২৫ শে মার্চ কাল রাত থেকে পরবর্তীতে শহীদদের মধ্যে ৬৬ জনের পরিচয় পাওয়া যায়, তাঁদের নাম গণসমাধির শ্বেতপাথরের ফলকে উৎকীর্ণ আছে। এর বাইরে রয়ে গেছে অজানা সংখ্যার অনেক শহীদ। সমগ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাত্তরের শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজও হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ১৯৫ জনের পরিচয়সহ নাম রয়েছে। সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীদের বড় অংশই এই তালিকা প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদের সংখ্যা সহস্র বলেই তাঁরা জানেন।
আমরা সেই দুর্ভাগা নাগরিক, যারা তাঁদের পূর্বপুরুষের নৃশংস বর্বর হত্যার বিচার করতে ব্যর্থ, এমনকি আমরা ব্যর্থ হয়েছি তাঁদের নামগুলোও জানতে।