স্বাধীনতা অর্জনের পথে আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছিল সাগর পরিমাণ রক্ত। চড়ারহাট গণহত্যা একাত্তরে পাকিস্তানী অমানুষ ও তাদের দেশীয় সহচরদের হাতে সংঘটিত নির্মম বর্বরতার এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। দেশটির নাম বাংলাদেশ, এই দেশ অর্জনে প্রাণ দিয়েছেন ত্রিশ লক্ষাধিক মুক্তিকামী মানুষ। ভুলে যেন না যাই, ভুলে যেতে নেই।

 

সেদিন রোববার ১০ অক্টোবর ১৯৭১, অবরুদ্ধ বাংলায় পাকিস্তানী অমানুষদের হাতে সংঘটিত হয়েছিল আরও একটি গণহত্যা। আমরা যাকে বলছি ‘চড়ারহাট গণহত্যা’।

 

গণহত্যার পেছনের ঘটনাটি ছিল অনেকটা এমন, শনিবার ৯ অক্টোবর ১৯৭১ সালে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার আলতাদিঘী নামক স্থানে গরুর গাড়িতে চড়ে কিছু পাকিস্তানী সেনাসদস্য ক্যাম্পে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সফল অ্যামবুশের শিকার হয় ৭ পাকিস্তানী সৈন্য। সাথে ছিল দুই রাজাকার, সেই রাজাকাররা বিরামপুর হানাদার বাহিনী ক্যাম্পে খবর দেয়। খবর পেয়ে স্থানীয় পাকিস্তানী ক্যাম্প কমান্ডার জনৈক মেজর (সম্ভবত মেজর কামরুজ্জামান) সেদিন রাতেই পুটিমারা ইউনিয়নের চড়ারহাট (প্রাণকৃঞ্চপুর) ও আন্দোলগ্রাম (সারাইপাড়া) ঘেরাও করে।

পরদিন অর্থাৎ ১০ অক্টোবর সকালের দিকে বাঙালি নারী-পুরুষকে কাজের কথা বলে ডেকে নিয়ে একত্রিত করে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে।

 

প্রত্যক্ষদর্শীদের দেয়া তথ্য অনুসারে জানা যায়, চড়ারহাট (প্রাণকৃষ্ণপুর) গ্রামের ২ জন নারীসহ ৬৭ জন ও পার্শ্ববর্তী আন্দোলগ্রাম সরাইপাড়া গ্রামের ৩১ জন নিরীহ গ্রামবাসী সেদিন শহীদ হয়েছিলেন।

 

চড়ারহাট প্রাণকৃঞ্চপুরে পুরুষদের এক করে গ্রামের পূর্বদিকের শেষ প্রান্তে একটি বীজ তলায় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। আন্দোলগ্রামে পাক বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

 

সেদিন চড়ারহাট গ্রামের ৮ জন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। বেঁচে থাকলেও তাঁরা গুলির আঘাতের ক্ষত আর স্বজন হারানোর বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁদেরই একজন শহীদ মনছের আলীর পুত্র চড়ারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ মোজাম্মেল হক (৬৯)। সেদিন তিনি বাবা এবং ছোট ভাই মকবুল হোসেনকে হারিয়েছেন। তিনিও হয়েছিলেন গুলিবিদ্ধ।

 

মোজাম্মেল হক আমাদের জানিয়েছেন, ‘সেদিন তিনি ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যান। মসজিদে ১০/১২ জন নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ শেষে গ্রামের প্রবীন ব্যক্তি মোঃ মফিজ উদ্দিনসহ অনেকেই খবর দেন যে, পাকিস্তানী মেজর সবাইকে ডাকছে। ভাঙ্গা সেতু নির্মান করতে মাটি কাটতে হবে। কথা শুনে বুকটা কেঁপে ওঠে। কিন্তু মুরুব্বিদের আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে সকলেই আমরা গ্রামের পূর্ব দিকে একটি মাঠে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি গ্রামের প্রায় সকল পুরুষ মানুষকে একত্র করা হয়েছে। এরপর পাকিস্তানী সেনারা নির্বিচারে ব্রাশফায়ার করে’।

 

এ গণহত্যায় মোজাম্মেল হকের বাবা এবং ছোট ভাই শহীদ হন। তিনি নিজেও বাম পা এবং ডান হাতে গুলি বিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাঁকে মৃত ভেবে চলে যাওয়ায় তিনি বেঁচে যান।

সে সময় সব শহীদদের মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। শহীদদের মধ্যে ৯৩ জনের মরদেহ শনাক্ত করা হয়েছিল। যার মধ্যে চড়ারহাট (প্রাণকৃঞ্চপুর) গ্রামের ৬১ জন ও আন্দোলগ্রামের (সারাইপাড়া) ৩২ জন ছিল। ওই সময় এক কবরে একাধিক মরদেহ দাফন করা হয়।

গত ২০১১ সালে চড়ারহাট গণহত্যার শহীদদের জন্য একটি শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি হয়েছে।