‘শহীদ’ মতিয়ুর রহমান মল্লিক

‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি, তুমি মনে করো তোমার ছেলে বাংলার মানুষের জন্য জীবন দিয়ে গেছে।

ইতি— মতিয়ুর রহমান মল্লিক,

দশম শ্রেণি, নবকুমার ইনস্টিটিউট।’

পিতা আজহার আলী মল্লিক।

ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।’

 

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ উৎসর্গকারী এই কিশোরের জন্ম ও মৃত্যুদিন একই। মাত্র ১৬ বছর আগে ঠিক যেদিন (২৪ জানুয়ারি ১৯৫৩) তিনি পৃথিবীর আলোয় এসেছিলেন, ১৬ বছরের ব্যবধানে সেই একই দিন (২৪ জানুয়ারি, ১৯৬৯) তিনি বিদায় নিয়েছিলেন! মাঝে মাঝেই তারিখের এমন খেয়ালি মিল আমাদের বেশ ভাবায়।

 

মাত্র ষোল বছর বয়সের এক কিশোর। নবম শ্রেণি পাশ করে সবে দশম শ্রেণিতে উঠেছে। পুরোনো ঢাকার বকশিবাজারে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী স্কুল নবকুমার ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র সে। তার নাম মতিয়ুর, পুরো নাম মতিয়ুর রহমান মল্লিক।

 

তাঁর বাবা আজহার আলি মল্লিক ছিলেন ব্যাংক কর্মচারি। বেশ টানাটানির সংসার। এমনই এক সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়েও মতিয়ুর রহমান মল্লিকের নাম আজ বাংলার স্বাধিকারের ইতিহাসে উজ্জ্বল। আমরা তাকে স্মরণ করি পরম ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর গৌরবের সাথে। সেদিনের সেই মতি বা মতিয়ুর রহমান মল্লিক আজ শহীদ মতিয়ুর নামেই সবার কাছে পরিচিত। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে সেই সংগ্রামের এক পর্যায়ে কিশোর মতিয়ুরের সাহস ও আত্মত্যাগ চলমান আন্দোলন-সংগ্রামকে আরও বেগবান করে।

 

২০শে জানুয়ারি ১৯৬৯ এ, আসাদের মৃত্যুর পর সংগ্রামে আসা ছাত্ররা পকেটে ঠিকানা লিখে নিয়ে আসত। দেশের জন্য জীবন উৎস্বর্গ করা কিশোর শহীদ মতিয়ুরের বুক পকেটে পাওয়া চিরকুটে তাঁর নিখাদ দেশপ্রেমের যে বিশলাতা দেশবাসী দেখতে পায়-তা যেন দিগন্তু বিস্তৃত আকাশ এবং সাগরের বিশালতাকেও হার মানায়।

 

আসাদ হত্যার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা প্রদেশব্যাপী (পূর্ব পাকিস্তান) তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে।২২ জানুয়ারি কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ তারিখ মশাল মিছিল আর ২৪ তারিখ ২টা পর্যন্ত হরতাল।

 

২৪ তারিখ হরতালে,সকাল থেকে ছাত্র-জনতা নেমে এলো ঢাকায়। বিক্ষোভে উত্তাল রাজপথ। সচিবালয়ের পাশে আবদুল গণি রোডে মন্ত্রীর বাড়িতে আক্রমণ হলে সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ হলে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিয়ুরের সঙ্গে মকবুল,রুস্তমসহ চারজন নিহত হয়।

 

সর্বত্র এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে ঢাকার মানুষ বিক্ষোভে নেমে আসে রাজপথে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলল ঢাকায়। সেই আগুনে পুড়তে থাকলো দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ অফিস, পুরান পল্টনে ‘এমএনএ’ লস্করের বাড়ি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিশেষ আদালতের বিচারকের বাড়ীতে আক্রমন হলে বিচারপতি এস এ রহমান লুঙ্গি পরে প্রাণ নিয়ে পালায়। ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে শহীদ মিনারে আসাদের রক্ত ছুঁয়ে এদেশের ছাত্র-জনতা যে শপথ নিয়েছিল, ২৪ জানুয়ারি মতিয়ুরের রক্তে সেই সংগ্রাম বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে।

 

২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান ঘটলে বিকাল ৩টার পর সান্ধ্য আইনের সময়-সীমা ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মানুষ তা অমান্য করে বানের স্রোতের মতো নেমে আসে রাজপথে। সান্ধ্য আইনের মধ্যে মতিয়ুরের লাশ তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলে যে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল,সেদিনের ছাত্র-জনতা তা কেবল শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন,কিন্তু সেই বেদনাবিধুর বিয়োগ ব্যথায় ভারাক্রান্ত পরিবেশ ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব। সাধারন বাঙালি পরিবারের সাদামাটা সহজ সরল মহীয়সী নারী মতিয়ুরের মা সন্তানের লাশ সামনে নিয়ে সেদিন বলেছিলেন,‘আমার সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’

 

ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিশোর সৈনিক শহীদ মতিয়ুরের রক্ত বৃথা যায়নি। তার রক্তের ধারা বেয়েই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। ফলে, সামরিক স্বৈরাচার আইয়ূবের ক্ষমতার অবসান ঘটে। এর পরেই আসে সত্তরের নির্বাচন, নির্বাচনে বাঙালির বিজয়, ক্ষমতা হস্তান্তরে পরবর্তী স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের নানা ছলচাতুরি, প্রতারণা এবং সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মলাভ।

 

কিশোর শহীদ মতিয়ুর শুধু ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের অদম্য প্রেরণাশক্তি নয়। বাঙালির মহান মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসেও তার আত্মদান চিরদিন অম্লান থাকবে। শহীদ মতিয়ুর কিশোর-তরুণদের কাছে সাহস আর শক্তির প্রতীক। কিশোর-তরুণেরাও যে দেশের জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, নির্ভয়ে জীবন দিতে পারে।

 

ঊনসত্তরের শহীদ মতিয়ুর সে দৃষ্টান্তই রেখে গেছেন আমাদের জন্য।

 

কৃতজ্ঞতাঃ মরহুম আজহার আলী মল্লিক (শহীদ পিতা)