ষাটের দশকের ডিআইটি ভবন, একাত্তরে এখানেই টেলিভিশন প্রচার কেন্দ্র অবিস্থিত ছিল

সেদিন বৃহস্পতিবার ২৮ অক্টোবর ১৯৭১, ঘড়ির কাঁটায় আনুমানিক বেলা সোয়া একটা। স্বাধীনতা অর্জনে লড়াইরত গেরিলা যোদ্ধারা স্থাপন করেছিলেন অবিশ্বাস্য সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এদিন পরিচালিত হয়েছিল ডিআইটি ভবনে (বর্তমান রাজউক) অবস্থিত তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা সম্প্রচার কেন্দ্রে দুর্ধর্ষ এক গেরিলা অপারেশন।

 

প্রকাশ্য দিবালোকে পরিচালিত এ গেরিলা অপারেশন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাঁদের দেশী-বিদেশী দোসরদের মনোবলে প্রচণ্ড আঘাত করেছিল। কারণ, পাকিস্তান টেলিভিশনের পূর্ব পাকিস্তান কার্যালয়টি ছিল তৎকালীন গভর্নর হাউস বা এখনকার বঙ্গভবনের অতি নিকটে। যে গভর্নর হাউসে ‘ঠ্যাঁটা মালেক’ নামে পরিচিত আবদুুল মোতালিব মালেক থাকতো। যেখানে বসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, রাও ফরমান আলী থেকে নিয়াজীর নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো।

 

দৃঢ় নিরাপত্তার ৩০ গজের ভেতর এত বড় একটি বিস্ফোরণের পর পাকিস্তান বাহিনী বুঝে গিয়েছিল,তাদের নিরাপত্তাব্যুহ একদমই সুরক্ষিত নয়। দুর্ধর্ষ এই গেরিলা অপারেশন প্রচারিত হয়েছিল বিবিসির সংবাদেও। সেখানে বলা হয়েছিল, মুক্তিবাহিনী এখন পাকিস্তানি বাহিনীর নিরাপত্তা প্রাচীরের স্পর্শকাতর স্থানে চলে এসেছে। যার প্রমাণ ঢাকার টেলিভিশন সম্প্রচার ভবনে মুক্তিবাহিনীর সফল হামলা।

 

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ৬ টি কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী পেড়িয়ে এই বিস্ফোরণ ঘটাবার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল প্রায় ১২ পাউন্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ (পিকে), ফিউজ এবং ডেটোনেটর। এ অপারেশনে টেলিভিশন কার্যালয়ের সাধারণ বিভাগের কর্মকর্তা শ্রদ্ধেয় মাহবুব আলী অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখেন। এবং মূল বিস্ফোরণটি ঘটান ফেরদৌস ও জন নামের দুই কিশোর দুর্ধর্ষ গেরিলা। তাঁরা দুজনেই ছিলেন ঢাকা সদর ও উত্তর বাহিনীর (মানিক বাহিনী) ঢাকা শহর বিশেষ প্লাটুনের সদস্য। এদের মাঝে গেরিলা ফেরদৌস নাজমী (সাঈদ ইকবাল নাজমী) ছিলেন বড় মগবাজার এবং নজিবুল্লাহ জন পুরনো ঢাকার নারিন্দা নিবাসী।

 

অক্টোবরের শুরু থেকে এই অপারেশনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। ডিআইটি ভবন অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল ট্রান্সমিশন সেন্টার, টাওয়ারের উপর টেলিভিশনের অ্যান্টেনা টাওয়ার ফেলে দেয়া এবং নিচে যেখানে রেকর্ড স্টুডিও উড়িয়ে দেয়া। ডিআইটি ভবনে প্রবেশের জন্যে মাহবুব আলী, ফেরদৌস ও জনকে দুটি এন্ট্রি পাশ জোগাড় করে দিলেন। সেই এন্ট্রি পাশ ব্যবহার করে তাঁরা ডিআইটি ভবনে প্রবেশ করে পাঁচ থেকে সাত মিনিট সময়ের মধ্যে তাঁরা রেকি করলেন। বিস্ফোরণের স্থানটির পরিমাপ নেয়া ছাড়াও কাটিং চার্জ বসাবার জায়গা নির্দিষ্ট করলেন। মূল সমস্যা হলো, হামলা চালাতে হলে ভেতরে এক্সপ্লোসিভ নিতে হবে। সে কাজটিও মাহবুব আলীই করেছিলেন। তিনি তখন প্রতিদিন একটু একটু করে এক্সপ্লোসিভ ভেতরে নিয়ে যেতেন। খুব সতর্কভাবে কাজটি করা হচ্ছিল। কারণ কোনো অবস্থাতেই ধরা পড়া যাবে না।

 

ডিআইটি’তে কর্মরত মাহবুব আলী’র সাথে গেরিলা ফেরদৌস ও জন আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন যে, জুতাের মধ্যে পায়ের পাতার নিচে এবং পায়ে নকল ব্যাণ্ডেজের ভেতর করে এগুলাে নেয়া হবে। অফিসে যাওয়ার আগে দুই পায়ে প্যান্টের নিচে ফার্স্ট এইড’ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল জন। এই ব্যাণ্ডেজের নিচে রাখা হলাে প্যাকেট ছাড়ানাে ৪ আউন্স করে মােট আট আউন্স প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ (পিকে)। এই বিস্ফোরকটি দেখতে ঘরের চালে লাগাবার পুডিং-এর মতাে। দুই পায়ে জুতাের ভেতরে পায়ের পাতার নিচে এমনি করে দেয়া হলাে আরাে ৮ আউন্স পিকে । মাহবুব আলী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই ১২ দিনে মােট ১২ পাউন্ড পিকে ডিআইটি ভবনে প্রবেশ করালেন। ভেতরে নিয়ে যাওয়া বিস্ফোরক তিনি রাখতেন সাত তলার একটি পুরনো নথি রাখার কক্ষে।

 

এরই মাঝে ইপিআইডিসি’র পাশে হাবিব ব্যাংকের সামনে ট্যাক্সিতে রক্ষিত বােমার বিস্ফোরণ (গেরিলা রাইসুল ইসলাম আসাদ পরিচালিত গেরিলা অপারেশন এটি) পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে হতচকিত করে ফেলে। এর প্রতিক্রিয়ায় ডিআইটি ভবনে চেকপােস্টসমূহে তল্লাশী জোরালো হয়। মাহবুব আলীর পক্ষে বিস্ফোরক পাচার অসম্ভব হয়ে পড়লাে। বিস্ফোরণের মাত্রা ও ধ্বংস করার ক্ষমতা বাড়াতে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ বেশী ব্যবহারের বিকল্প নেই। কিন্তু বাস্তবতা তখন গেরিলাদের বিপক্ষে। হাবিব ব্যাংকের বিস্ফোরণের ঘটনার পরদিন পায়ে নকল ব্যাণ্ডেজের নিচে বেঁধে দেয়া হলাে ৬ ফুট গজ ‘ফিউজ ওয়্যার’। ফাউন্টেন পেনের ভেতরের অংশ ফেলে দিয়ে তার ভেতর দেয়া হলাে একটি ডেটোনেটর।

 

এর মাঝে হঠাৎ করেই সাততলার সেই পরিত্যক্ত ফাইল রুম গুছানাের প্রস্তুতি নেয়া হল। লুকোনাে বিস্ফোরক সহ অন্যান্য জিনিসপত্র ধরা পড়ার আশঙ্কায় তাঁরা খুব দ্রুত অপারেশন সম্পন্ন করতে চাইলেন।

 

অবশেষে ২৮ অক্টোবর ১৯৭১, পুনরায় গেরিলা যোদ্ধা ফেরদৌস ও জনের ডিআইটি ভবনে প্রবেশের পালা। এবার অডিশনের নাম দিয়ে এন্ট্রি পাশ সংগৃহীত হয়। বেলা পৌনে একটায় জন ও ফেরদৌস ডিআইটি ভবনে প্রবেশ করেন। সবগুলো চেকপােস্ট পার হয়ে ৬ তলায় যাবার পর সেখানে চেকপয়েন্টে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাে, ‘কিস লিয়ে যাতা হ্যায়?’ জন ও ফেরদৌস উপস্থিত বুদ্ধিতে তাঁরা বললেন,বুড়িগঙ্গার পানি কতটুকু বেড়েছে তা পরীক্ষার জন্যে তারা যাচ্ছে। অন্য আরেকজনকে তল্লাশিতে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় জন ও ফেরদৌসকে সেই পুলিশ বললো, ‘ঠিক হ্যায়, তুমলােগ যা সকতা’।

 

তাঁরা বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে সাত তলার সেই কক্ষে গিয়ে বিস্ফোরক একত্রিত করে চার্জ সেট করলেন। ফিউজ ওয়্যারের ইগনিশন পয়েন্ট ও ডেটোনেটর ফিট শেষে বেলা ১ঃ১২ মিনিটে ফিউজ ওয়্যারে অগ্নিসংযােগ করেন। এই ফিউজ ওয়্যার পুড়তে সময় লাগবে মাত্র ৩ মিনিট। এই তিন মিনিটের মাঝেই তাঁদের ডিআইটি ভবন থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। (সময় সম্পর্কে এই বিবরণটিই অংশগ্রহনকারী গেরিলাদের থেকে পাওয়া যায়)

 

তাঁরা না পারছেন দৌড়াতে না পারছেন হাঁটার গতি বাড়াতে। তাহলেই সন্দেহের চোখে আটক হবার শতভাগ সম্ভাবনা। প্রতিটি সেকেন্ড যেন তাঁদের একেকটি ঘণ্টার মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। যেখানে লােক নেই সেখানে দ্রুততার সাথে এবং লােক দেখলে অপেক্ষাকৃত ধীরলয়ে হাঁটলেন। এক সময় তাঁরা দুজনেই বেরিয়ে এলেন ডিআইটি ভবনের প্রধান ফটক দিয়ে।স্টেডিয়ামের বারান্দায় তাঁরা দাঁড়াবার কয়েক সেকেন্ডের ভেতর ঘটলাে প্রচন্ড বিস্ফোরণ।

ভবনের ভেতরে যেখানে মূল বিস্ফোরণটা ঘটেছিল, সেখানের টাওয়ার অংশ একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। এখন যে ঘড়িটা দেখা যায়, ভবনের সে ঘড়িটাও অচল হয়েছিল। জানালার কাচ ভেঙে আশপাশে পড়ে গেল। ডিআইটির ফাইলগুলো উড়ে এসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাস্তায় উড়ে এসেছিল। ডিআইটি ভবনের পাশের ভবনগুলোও বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠেছিল।

 

সেদিন যেসব জানালার কাঁচ ভেঙে ছড়িয়েছিল রাস্তা জুড়ে,তা যেন অবরুদ্ধ ঢাকায় পাকিস্তানী হার্মাদদেরই দম্ভ চূর্ণ হবারই প্রতিরূপ।

 

🖐 তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চূ।

👉 স্বাধীনতার সংগ্রাম ঢাকায় গেরিলা অপারেশনঃহেদায়েত হোসাইন মোরশেদ