কল্পনাতীত নৃশংসতা
‘বাবারে নড়িসনে, গলাডা বাড়ায়ে দে, তোরও কষ্ট হবে নানে, আমারো হবে নানে’
একাত্তরে বাগেরহাট জেলায় নরক থেকে নেমে এসেছিল একাধিক অমানুষ নরপিশাচ। এদেরই একজন ছিল আকিজউদ্দিন, সে ছিল কুখ্যাত রাজাকার রজ্জব আলীর ‘কিলিং মেশিন’।
একাত্তরে নিরপরাধ মুক্তিকামী বাঙালি হত্যায় বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার রজ্জব আলী ফকির গুলি না করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে মারতো। এ কাজে সে নিয়োগ করেছিল দুই পিশাচ আকিজ উদ্দিন আর মজিদ কসাইকে। বিশেষভাবে আকিজ উদ্দিনের নৃশংসতা এতোটা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে,তার বর্বরতার কথা স্বাধীনতার পর পুরো বাগেরহাটে তো বটেই সমগ্র দেশেই ছড়িয়েছিল।
হত্যাকাণ্ডের সময়ে আকিজ উদ্দিনের আচরণ সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিক জানিয়েছেন,
”আকিজউদ্দিন ছিল আশি বছরের বৃদ্ধ। লম্বা ট্যাঙা শাদা চুলদাড়ি সাদা সুন্নতি পাঞ্জাবি সাদা লুঙ্গি সাদা টুপি। শীর্ণ শ্যামলা। তাকে নিয়ে এত বাক্যব্যয়ের কারণ আছে। এই দীর্ঘদেহী বৃদ্ধের উবু হতে গেলে কোমরে কষ্ট হত। তাই সে ভিক্টিমদের রিকোয়েস্ট করত নিজে থেকে মাটিতে শুয়ে পড়ে গলা পাতিয়ে দিতে। সহযোগী রাজাকাররা তাকে এ কাজে সাহায্য করত। তারপর সে রামদা শানাতে শানাতে হাসতে হাসতে বলত, ‘‘বাবারে! নড়িসনে! গলাডা বাড়ায়ে দে! তোরও কষ্ট হবে নানে, আমারো কষ্ট হবে নানে।” এবং সে সারি পাতা গলাগুলোর উপর দিয়ে রামদা চালিয়ে যেত। আকিজ উদ্দিনের নাম হয়ে গিয়েছিল রামদা স্পেশালিস্ট।”
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীয় বাগেরহাট শান্তি কমিটির নেতা রজ্জব আলী ফকির, শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার এবং আকিজ উদ্দিন ছিল অন্যতম নৃশংস জল্লাদ। বাগেরহাটের জেলা পরিষদের ডাকবাংলো ছিলো রাজাকারদের অন্যতম ঘাটি।
কুখ্যাত কসাই সিরাজ প্রতিদিন সকালে নিজ হাতে মানুষ জবাই না করে নাস্তা পর্যন্ত গ্রহণ করতো না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিরাজ মাস্টার বাগেরহাট শহরের ডাকবাংলা ঘাটে মুক্তিকামী শত শত মানুষকে ধরে এনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করার কারণে রাতারাতি সিরাজ মাস্টার কসাই সিরাজ হিসেবে কুখ্যাতি পায়।
একাত্তরের ২১ মে , রামপাল থানার ডাকরা কালীবাড়িতে গণহত্যার সময় আকিজ উদ্দিন এবং মজিদ কসাইকে নিয়ে প্রাণহীন দেহগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে, সামান্য আহত বা মৃতদেহের নীচে অক্ষত কাউকে পাওয়া মাত্রই তাঁদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করেছিল এই দুই নরপিশাচ।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম খোকনের ‘রফিক বাহিনী’র যোদ্ধারা এই কুখ্যাত কসাই সিরাজ মাস্টারকে আটক করে। একই সময়ে আটক হয় রাজাকার আকিজ উদ্দিনকেও। তখন বাগেরহাট শহরে টিকেটের বিনিময়ে সাধারণ জনগনকে এই কুখ্যাত দুই রাজাকার লোহার খাচায় আটকে রেখে প্রদর্শনীর জন্য টিকিট দেয়া হয়েছিল। তখন কসাই সিরাজ মাস্টারকে দেখে তার গায়ে থুথু মেরে ঘৃণা প্রকাশ করতো। দেশ স্বাধীনের পর দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি ছিল এই রাজাকার। পঁচাত্তরের পর এরা সসম্মানে মুক্তি পায়। আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ডাকরা সহ দেশের অসংখ্য বধ্যভূমি। খোদ রাজধানীতে বিলীন হয়ে গেছে নুন্যতম অর্ধ শতাধিক বধ্যভূমি।
★সিরাজ কসাইয়ের ফাঁসি অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে ২০১৫ সালে। সে আপিল করেছে এবং পাঁচ বছরেও সেই আপিলের সুরাহা হয়নি! আকিজউদ্দিন বয়সজনিত কারণে আগেই মারা গেছে, মৃত্যুর সময় জানা যায়না।
★★ছবিঃ একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধৃত খুলনা অঞ্চলের দুই রাজাকারের। নরপিশাচ আকিজ উদ্দিনের কোন ছবি আমরা পাইনি। কারও সংগ্রহে থাকলে একটি কপি অনুদান হিসেবে দিলে কৃতজ্ঞ রইবো।